বাগেরহাট জেলার নদ নদী

বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বাগেরহাট জেলা একটি ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ জনপদ। ভৌগোলিক দিক থেকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম নদীমাতৃক এলাকা। জেলার সীমান্তের একদিকে রয়েছে বিশাল বঙ্গোপসাগর, অপরদিকে গোপালগঞ্জ, নড়াইল, খুলনা বরগুনা জেলা। বাগেরহাটের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত অসংখ্য নদনদী শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেই বহন করছে না, বরং অঞ্চলের কৃষি, মৎস্যসম্পদ, নৌপরিবহন, বনসম্পদ এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বিশেষত সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা বাগেরহাটের নদীগুলো দেশের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রাণরস হিসেবে কাজ করছে। এসব নদী বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত হয়ে জেলাকে একটি স্বতন্ত্র নদীবাহিত ভৌগোলিক চরিত্র দিয়েছে।

 

বাগেরহাট জেলার নদ নদী

বাগেরহাট জেলার নদ নদী

বাগেরহাট জেলার প্রধান নদ-নদী

১. দড়াটানা নদী

মোল্লাহাট উপজেলার কেন্দুয়া বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে এই নদী প্রথমে ভৈরব নদী নামে প্রবাহিত হয়। পরে এটি দড়াটানা নদী নামে পরিচিত হয় এবং পুনরায় পয়লাহারা নদী হয়ে শেষ পর্যন্ত পানগুছি নদী নামে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

  • দৈর্ঘ্য: আনুমানিক ১৭৫ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: জেলার কৃষি, মাছ ধরা ও নৌপরিবহনে এ নদীর অবদান অপরিসীম।
২. পশুর নদী

খুলনা জেলার রূপসা নদীর নিম্নমুখী অংশ পশুর নদী নামে পরিচিত। এটি বাগেরহাটের মোংলা ও সুন্দরবন অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

  • দৈর্ঘ্য: প্রায় ৯৫ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: মোংলা সমুদ্রবন্দর এ নদীর তীরে অবস্থিত, যা জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
৩. বিষ্ণু-কুমারখালি নদী

বাদোখালী ও যৌখালী বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে বিষ্ণু নদী ধীরে ধীরে কুমারখালী নদী নামে পরিচিত হয় এবং রামপাল উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোংলার পশুর নদীতে মিশেছে।

  • দৈর্ঘ্য: আনুমানিক ৬৫ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: কৃষিকাজ ও স্থানীয় নৌপথের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
৪. কাটাখাল নদী

কুমার নদী হতে পানগুছি নদীতে সরাসরি যোগাযোগের জন্য বিআইডব্লিউটিএ খনন করে এই নদী সৃষ্টি করেছে। এটি স্থানীয়ভাবে “প্লানের নদী” বা “কাটাখাল” নামে পরিচিত।

  • দৈর্ঘ্য: প্রায় ৭ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: যোগাযোগ ও জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম খাল হলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত উপকারী।
৫. মধুমতি নদী

মোল্লাহাট ও চিতলমারী উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদী পিরোজপুর হয়ে কালিগঙ্গায় পতিত হয়েছে।

  • দৈর্ঘ্য: প্রায় ৩০ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: এ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল কৃষিতে উর্বর এবং পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৬. ভৈরব নদী

রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ভৈরব নদী বাগেরহাটের যাত্রাপুরে চিত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়।

  • দৈর্ঘ্য: প্রায় ২০ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: স্থানীয় বাজার, কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য।
৭. খরমা নদী

মোংলা উপজেলার শিলাগাং থেকে উৎপত্তি হয়ে খরমা নদী মোড়েলগঞ্জ হয়ে শরণখোলার ভেতর দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত বলেশ্বর নদীতে পতিত হয়।

  • দৈর্ঘ্য: প্রায় ৫৫ কিলোমিটার
  • গুরুত্ব: মৎস্য আহরণ, বনসম্পদ আহরণ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

 

বাগেরহাট জেলার নদ-নদীর বিস্তৃত তালিকা (অক্ষরক্রমে)

  • আ: আর্মাল নদী
  • ঘ: ঘাঘর নদী, ঘাসিয়াখালী নদী
  • দ: দড়াটানা-পয়লাহারা নদী
  • প: পশুর নদী, পানগুছি নদী, পুটিমারি নদী, পুরাতন পশুর নদী
  • ব: বগী নদী, বলেশ্বর নদী, বিষ্ণু-কুমারখালি নদী
  • ভ: ভৈরব নদী (বাগেরহাট), ভোলা নদী
  • ম: মোংলা নদী
  • শ: শৈলদাহ নদী
  • স: Supoti নদী
  • হ: হরিণঘাটা নদী

 

নদ-নদীর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব

১. কৃষি উন্নয়ন:
বাগেরহাটের কৃষিজমি নদীগুলির মাধ্যমে সেচ পায়। নদীর পলল ভূমিকে উর্বর করেছে। ধান, পাট, শাকসবজি চাষে নদীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

  1. মৎস্যসম্পদ:
    নদীগুলো প্রচুর মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে চিংড়ি চাষ ও আহরণ জেলার মানুষের অন্যতম জীবিকা।
  2. পরিবহন বাণিজ্য:
    নৌপথ বাগেরহাটের জীবনরেখা। মোংলা বন্দর, স্থানীয় হাটবাজার ও গ্রামীণ যোগাযোগে নদীগুলো প্রধান ভরসা।
  3. জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ:
    সুন্দরবন এবং এর আশেপাশের নদীগুলো বাঘ, হরিণ, কুমির, ডলফিনসহ বহু প্রাণীর আবাসস্থল। নদী কেন্দ্রিক পরিবেশগত ভারসাম্য জেলাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
  4. পর্যটন উন্নয়ন:
    ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর সমাধি, সুন্দরবন এবং নদীভিত্তিক পর্যটন বাগেরহাটকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র করেছে।

বাগেরহাট জেলার নদ নদী

 

সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ

যদিও নদীগুলো বাগেরহাটের জীবনরেখা, তবে বর্তমানে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে:

  • নদী ভরাট ও পলি জমা
  • নৌপথ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া
  • চিংড়ি খামারের প্রভাবে পানিদূষণ
  • জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততার বৃদ্ধি

সঠিক সংরক্ষণ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া এ সম্পদ দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

বাগেরহাট জেলার নদ-নদী শুধু ভৌগোলিক সত্তার প্রতীক নয়, বরং এ অঞ্চলের অর্থনীতি, পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মূল চালিকাশক্তি। কৃষি, মৎস্য, বনসম্পদ আহরণ, নৌপরিবহন এবং পর্যটন—সব ক্ষেত্রেই নদীগুলোর অবদান অপরিসীম। তাই এই নদীগুলির সঠিক সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি।

নদীমুখী বাগেরহাট—এই পরিচিতি শুধু ইতিহাস নয়, এটি এ জেলার বর্তমান ও ভবিষ্যতের উন্নয়নকেও নির্দেশ করে।

১ thought on “বাগেরহাট জেলার নদ নদী”

Leave a Comment