আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাগেরহাট জেলার অভ্যুদয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। বাগেরহাট কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থানই নয়, বরং এটি বহুযুগের মানব বসতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় পরিবর্তন ও সামাজিক বিবর্তনের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
Table of Contents
বাগেরহাট জেলার অভ্যুদয়
প্রাচীন বসতি ও অনার্য প্রভাব
বাগেরহাট অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করে অনার্য শ্রেণীর মানুষ। এর মধ্যে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলপাইন জাতিগোষ্ঠী। তাদের প্রভাবের বড় নিদর্শন হলো পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়, যাদের অনেকাংশ এখনও রামপাল উপজেলায় বসবাস করে।
“পৌন্ড্র” শব্দটি দ্রাবিড় শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ আখ বা ইক্ষু। এ ছাড়াও নমশূদ্র সম্প্রদায়ের (পূর্ব নাম চণ্ডাল) মানুষরা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসতি গড়ে তোলে। আবার মৎস্যশিকারী জেলে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিগ্রোবটু বা নিগ্রোয়েডদের বংশধরও পাওয়া যায়, যারা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন অধিবাসী।
খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে আর্য জাতির আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। তারা সূর্য ও অগ্নির পূজা করত এবং বৈদিক ধর্ম নিয়ে আসে। অপরদিকে অনার্যরা কৌমধর্ম বা উপজাতীয় ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে আর্য ও অনার্যদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মিশ্রণ থেকে ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
প্রত্ননিদর্শন ও ধর্মীয় প্রভাব
বাগেরহাটের অভ্যুদয়ের প্রমাণ মেলে নানা প্রত্ননিদর্শনে।
- পানিঘাটে পাওয়া কষ্টিপাথরের অষ্টাদশ ভূজা দেবীমূর্তি,
- জাহাজঘাটায় উৎকীর্ণ অষ্টাদশ ভূজা মহিষমর্দিনী দেবীমূর্তি,
- চিতলমারীর খরমখালি গ্রামে প্রাপ্ত কৃষ্ণপ্রস্তরের বিষ্ণুমূর্তি,
এসব নিদর্শন প্রমাণ করে যে এ অঞ্চলে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল।
অন্যদিকে, ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী খনন করেন খাঞ্জেলী দীঘি। দীঘি খননের সময় পাওয়া যায় একটি ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধমূর্তি, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে স্থাপন করেন। এটি এ অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রভাবের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
বাগেরহাট জেলার নামকরণ
বাগেরহাট নামকরণের পেছনে রয়েছে কয়েকটি মতবাদ—
১. বাঘের উপদ্রব তত্ত্ব – অনেকের মতে, সুন্দরবনের নিকটে হওয়ায় এ অঞ্চলে বাঘের উপদ্রব ছিল। সেই কারণে এর নাম হয়েছিল “বাঘেরহাট”, যা পরবর্তীতে বাগেরহাট হয়ে যায়।
২. খান জাহান আলীর “বাগ” তত্ত্ব – হযরত খান জাহান আলী প্রতিষ্ঠিত “খলিফাত-ই-আবাদ”-এর সমৃদ্ধ বাগানসমূহ থেকে এ অঞ্চলের নাম হয় “বাগের আবাদ” তথা বাগেরহাট।
৩. বাঁকেরহাট তত্ত্ব (গ্রহণযোগ্য মত) – ভৈরব নদীর উত্তরদিকে হাড়িখালী থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত একটি বড় বাঁক ছিল। সেই বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় বসত হাটের নাম ছিল “বাঁকেরহাট”। কালক্রমে এর উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে “বাগেরহাট” নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাগেরহাটের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বহুমাত্রিক। অনার্য, আর্য, হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার ধারাবাহিকতা এবং খান জাহান আলীর ইসলাম প্রচার কার্যক্রম—সবকিছু মিলেই এ জেলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার গড়ে উঠেছে। প্রত্ননিদর্শন ও নামকরণের বিবর্তন আজও বাগেরহাটকে ইতিহাসপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে এক অনন্য জেলা হিসেবে তুলে ধরে।
১ thought on “বাগেরহাট জেলার অভ্যুদয়”