বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহাসিক জেলা বাগেরহাট খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। এই জেলা শুধু প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সারা দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুপরিচিত। বিশেষত খান জাহান আলীর প্রতিষ্ঠিত খলিফাতাবাদ নগরী, ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী ষাট গম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবনের প্রান্তিক ভূখণ্ড, প্রাচীন দীঘি ও মঠ, এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা বন্দর—এসব মিলেই বাগেরহাটকে করেছে অনন্য।

Table of Contents
বাগেরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
১. ষাট গম্বুজ মসজিদ
বাগেরহাট জেলার সবচেয়ে খ্যাতনামা নিদর্শন হলো ষাট গম্বুজ মসজিদ।
- এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম বৃহৎ মসজিদগুলোর একটি এবং ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত।
- যদিও মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি নেই, তবে ইতিহাসবিদদের মতে এটি ১৫শ শতাব্দীতে খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন।
- নাম ষাট গম্বুজ হলেও আসলে এর গম্বুজের সংখ্যা ৭৭টি এবং স্তম্ভ রয়েছে ৬০টি।
- মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ইসলামী, তুর্কি এবং বাংলা ধাচের এক অনন্য সমন্বয়।
২. সুন্দরবন
বাগেরহাট জেলার আরেকটি গৌরব হলো সুন্দরবন—বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।
- এটি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার একটি অংশ জুড়ে বিস্তৃত।
- রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমিরসহ অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থল এই বনভূমি।
- সুন্দরবন স্থানীয় মানুষের অর্থনীতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং পর্যটনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- মধু, গোলপাতা, কাঠ ও মাছ সংগ্রহের মাধ্যমে এখানকার বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।
৩. খান জাহান আলীর মাজার
বাগেরহাট জেলার ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন খান জাহান আলী (রঃ) (১৩৬৯–১৪৫৯)।
- তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক, মুসলিম ধর্ম প্রচারক ও শাসক।
- তার মাজার বাগেরহাট শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
- মাজারটি লাল ইট দিয়ে নির্মিত এবং আজও অসংখ্য ভক্ত এখানে আসেন দোয়া ও মানত করতে।
- স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি শুধু শাসক নন, বরং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও পরিচিত।
৪. মোংলা বন্দর
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা বন্দর বাগেরহাট জেলাতেই অবস্থিত।
- ১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত এ বন্দরটির প্রাচীন নাম ছিল চালনা বন্দর।
- পরবর্তীতে পশুর নদীর মোহনায় বন্দর স্থানান্তরিত হয়ে মংলা নাম গ্রহণ করে।
- আজ এটি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাগেরহাটের ভূমিকা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫. খাঞ্জেলী দীঘি
খান জাহান আলীর মাজারের দক্ষিণ দিকে প্রায় ২০০ বিঘা জমি জুড়ে অবস্থিত এই দীঘি।
- দীঘিটির নামকরণ নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত। কেউ কেউ বলেন এটি “ঠাকুর দীঘি” নামেও পরিচিত ছিল।
- ধারণা করা হয়, খান জাহান আলীর তত্ত্বাবধানে এ দীঘি খনন করা হয়।
- এখনো এটি স্থানীয় ও দূরদূরান্তের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি স্থান।
৬. বাগেরহাট জাদুঘর
১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট জাদুঘর জেলার ঐতিহ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
- এটি খলিফাতাবাদ নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ করে।
- এখানে ষাট গম্বুজ মসজিদ ও অন্যান্য মসজিদ সম্পর্কিত প্রত্নবস্তু, প্রাচীন পাথরের ভাস্কর্য, মুদ্রা এবং ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষিত রয়েছে।
৭. কোদলা মঠ (অযোধ্যা মঠ)
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার অন্তর্গত এই প্রাচীন মঠটি ১৭শ শতাব্দীতে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
- স্থানীয়ভাবে এটি অযোধ্যা মঠ নামেও পরিচিত।
- মঠটি লাল ইট দিয়ে নির্মিত এবং এর স্থাপত্যশৈলীতে প্রাচীন বাংলার হিন্দু ধর্মীয় রীতি প্রতিফলিত হয়েছে।
৮. রেজা খোদা মসজিদ (ছয় গম্বুজ মসজিদ)
বাগেরহাট সদর উপজেলায় অবস্থিত আরেকটি প্রাচীন নিদর্শন হলো রেজা খোদা মসজিদ, যা ছয় গম্বুজ মসজিদ নামেও পরিচিত।
- এটি খান জাহান আলীর সময়কার নির্মাণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
- এর স্থাপত্যশৈলীতে ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সব মিলিয়ে বাগেরহাট জেলা বিখ্যাত—
- ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী ষাট গম্বুজ মসজিদ ও প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যের জন্য,
- বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থলের জন্য,
- সুফি সাধক খান জাহান আলীর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও মাজারের জন্য,
- দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং সমৃদ্ধ বাণিজ্যের জন্য,
- এবং খাঞ্জেলী দীঘি, কোদলা মঠ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য।
বাগেরহাট তাই ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনন্য সংমিশ্রণ, যা শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতও।
২ thoughts on “বাগেরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত”